March 9, 2017

খারাপ নারীরা খারাপ পুরুষদের জন্য, ভাল নারীরা ভাল পুরুষদের জন্য! তাই নাকি??

দুশ্চরিত্রা নারীরা দুশ্চরিত্র পুরুষদের জন্য, সচ্চরিত্রা নারীরা সচ্চরিত্র পুরুষদের জন্য!! সত্যিই কি তাই??

[ক]
বিখ্যাত একটি আয়াত.. এটা নিয়ে অনেক রসালো গল্প রচিত হতে দেখা যায়। অবিয়াইত্তা পোলাদের কেউ এজন্য তৃপ্তির ঢেকুর তুলে, আর কেউ কপাল থাপড়ায়.. যাহোক! নারী দিবস উপলক্ষে এই আয়াতের দিকে আমরা কিছুক্ষণ মনযোগী হতে চাচ্ছি..
.
এই আয়াতের ওপর একটা ইশকাল বা আপত্তি উত্থাপন করে কেউকেউ। যার সারকথা হচ্ছে, "অনেক সময় দেখা যায় স্ত্রী খুব দ্বীনদার অথচ স্বামী বেদ্বীন। স্ত্রী অনেক নম্রভদ্র অথচ স্বামীটা বজ্জাত, কিংবা এর বিপরীতও দেখা যায়.. স্বামী বেচারা ভালো মানুষ, কিন্তু স্ত্রীটা জান ত্যানা ত্যানা করে দিচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে উল্লেখিত আয়াতের যথার্থতা কি? এটা কি ইউনিভারসাল ট্রুথ? অর সামথিং এল্স.."
.
প্রশ্নটা কোনো এক ভাই কয়েকদিন আগে করেছিলো, পরে উত্তর দিব বলে ব্যাপারটা একদমই ভুলে গিয়েছিলাম, আজ ইয়াদ হওয়ায় কিছু মুতালা'আ করে উনাকে সংক্ষেপে বললাম। আর মনে হলো বিস্তারিত পোস্ট লিখলে মন্দ হয় না..
.
ইসলাম ওয়েবে একটি প্রশ্ন ছিলো উপরেরটার মতই, তবে সাথে উদাহরণ হিসেবে লুত আ. এর স্ত্রীর কথা ছিলো..

যে লুত আ. তো নিখাদ ভালো মানুষ, অথচ উনার স্ত্রী কাফির! ইত্যাদি ইত্যাদি.. তো আমরা সংক্ষেপে আয়াতটার দিকে খেয়াল করি..
.
[খ]
সুরা নূর, ২৬নং আয়াতের শব্দগুলো দেখুন-

الْخَبِيثَاتُ لِلْخَبِيثِينَ وَالْخَبِيثُونَ لِلْخَبِيثَاتِ وَالطَّيِّبَاتُ لِلطَّيِّبِينَ وَالطَّيِّبُونَ لِلطَّيِّبَاتِ

এখানে الْخَبِيثَاتُ এবং َالْخَبِيثُونَ এর বেশ কয়েকটি অর্থ হতে পারে, এর অর্থ যেমন দুশ্চরিত্রের নারী - পুরুষ হতে পারে, তেমনি খবিসাত দ্বারা যেকোনো খারাপ কথা বা কাজও বুঝায়, নাপাকিও বুঝায়। মোটকথা, খারাপ কথা, কাজ, বস্তু, ব্যক্তি, জ্বিন সবকিছুর ক্ষেত্রেই খবীস শব্দ ব্যাবহার হয়।
অনুরূপভাবে, الطَّيِّبَاتُ দ্বারা ভালো বা পবিত্র কথা কাজ ব্যক্তি ইত্যাদি বুঝানো হয়।
.
তো আমাদের বাংলা উর্দুর প্রসিদ্ধ অনুবাদগুলোতে সম্ভবত খবিসাত তায়্যিবাত দ্বারা ব্যক্তি ধরে নিয়ে অনুবাদ করা হয়েছে, এজন্য আমাদের মাঝে "দুশ্চরিত্রা নারীরা দুশ্চরিত্র পুরুষদের জন্য.. সচ্চরিত্রা নারীরা সচ্চরিত্র পুরুষদের জন্য" এটা প্রসিদ্ধ।
আমি বলছিনা যে, সালাফের মাঝে এর নজির নাই বরং আমি বলতে চাচ্ছি আমাদের অনুবাদপ্রিয়তা এবং ভাষার সীমাবদ্ধতার দরুন এটা প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। যার কারণে উপরিউক্ত আপত্তি উত্থাপনের সুযোগ হচ্ছে- "কতশত ভালো মহিলা আছে যার স্বামী বজ্জাত!"
পক্ষান্তরে আপনি ইংলিশ অনুবাদ Saheeh International টা যদি দেখেন.. সেখানে কিন্তু আমাদের মত অনুবাদ নাই!
সেখানে আপনি পাবেন: "Evil words are for evil men, and evil men are [subjected] to evil words. And good words are for good men, and good men are [an object] of good words. Those [good people] are declared innocent of what the slanderers say. For them is forgiveness and noble provision."
দেখুন- https://quran.com/24/26
.
[গ]
এই প্রশ্নটা উত্থাপনই হতো না, যদি আমাদের অধিকাংশ মুফাসসিরিনে কিরামের মতামতটা জানা থাকতো। আচ্ছা, প্রথমে প্রচলিত অর্থের ব্যাপারে আলাপ করি, এর নিকটবর্তী মন্তব্য পাওয়া যায় ইমাম কুরতুবী রহ. এর। যা মুফতি শফি রহ. এর মারিফুল কোরআন মন্তব্যের অনুরূপ।
উনারা খবিসাত - তায়্যিবাত এর ক্ষেত্রে ব্যক্তি অর্থ নিয়ে ব্যাপারটা এভাবে ব্যখ্যা করেছেন-
"স্বাভাবিকভাবে খারাপ লোকদের আকর্ষণ খারাপ মেয়েদের প্রতি থাকে, আর পরহেজগার লোকদের আকর্ষণ দ্বীনদার পরহেজগার মেয়েদের প্রতি থাকে। আর জীবনসঙ্গী হিসেবে এরকমই মানানসই! মানে দ্বীনদারদের উচিত দ্বীনদার সঙ্গি বেছে নেয়া.." (মানে মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা বর্ণিত হয়েছে এখানে..) এই আর কি...!
.
খুবই চমৎকার এবং সাধাসিধা ব্যাখ্যা, এটা মেনে নিলেও কোনো আপত্তির অবকাশ থাকে না।
.
[ঘ]
তবে মুফাসসিরিনে কিরামের মাঝে আরেকধরণের ব্যাখ্যা প্রচলিত আছে, যা আয়াতের শানে নুযুলের সাথে অধিক মানানসই।
জমহুর (অধিকাংশ) মুফাসসির এটার যা ব্যাখ্যা দেন তার সারকথা হচ্ছে-
"এখানে খবিসাত বা তায়্যিবাত দ্বারা ব্যাক্তি নয় বরং কথা বা কাজ উদ্দেশ্য! অর্থাৎ ভালো কথা ভালো লোকেরাই বলে, খারাপ কথা খারাপ লোকেরা বলে এটা তাদের জন্য মানানসই..."
মুলতঃ আয়েশা রা. এর ওপর অপবাদ দেয়ার ঘটনায় যেসব আয়াতটা নাযিল হয়েছিল, তার মাঝে এটা একটা.. আয়াতের বাকি অংশও খেয়াল করুন-
أُوْلَئِكَ مُبَرَّؤُونَ مِمَّا يَقُولُونَ لَهُم مَّغْفِرَةٌ وَرِزْقٌ كَرِيمٌ

.
অধিকাংশ সালাফের মত বিবেচনায় নিলে পুরো আয়াতের অর্থ এরকম দাড়াচ্ছে-
"নোংরা কথা বা কাজ নোংরা লোক বা নারীদের জন্য, পবিত্র কাজ পবিত্র লোক বা নারীদের জন্য। তাদের সম্পর্কে লোকেরা যা বলে, তার সাথে তারা সম্পর্কহীন। তাদের জন্যে আছে ক্ষমা ও সম্মানজনক জীবিকা।"
.
তাহলে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আয়াতের ভাবার্থ এরকম,
"আয়েশা রা. এর নামে যারা অপবাদ ছড়িয়েছে, ওরা খারাপ লোক.. খারাপ কাজ খারাপ লোকদেরকেই মানায়, ওসব খারাপ কাজের সাথে আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা-র কোনো সম্পর্ক নাই। উনি এসব থেকে পবিত্র, বরং উনার জন্য দুনিয়া আখিরাতের উত্তম প্রতিদান রয়েছে।"
.
এই ব্যাখ্যাটা যারা করেছেন তারা হচ্ছে- "আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস, সাঈদ ইবনে যুবায়ের, মুজাহিদ রা. পরবর্তি আলেমদের মাঝে ইবনে কাসির রহ. এবং ইবনে তাইমিয়া রহ.-ও এরকমই অর্থ করেছেন।"
.
এই আয়াতের আলোচনায় আর বাকি থাকে লুত আ.এর স্ত্রীর কথা, ইবনে কাসিরওয়ালা উত্তরে বলেছেন- কাফির হওয়া আর চরিত্র খারাপ হওয়া আলাদা বিষয়, লুত আ. স্ত্রী কাফের ছিলেন কিন্তু তবুও উনি কখনো ব্যভিচার করেননি।
আল্লাহ সবচেয়ে ভালো জানেন...
.
[চ]
বিস্তারিত জানতে তাফসিরে কুরতুবী, ইবনে কাসীর, মারিফুল কোরআন, রুহুল মা'আনীতে সংশ্লিষ্ট আয়াতের তাফসীর দেখা যেতে পারে। এছাড়াও ইসলাম ওয়েবের সুওয়াল জাওয়াবের লিংক দিয়ে দিচ্ছি, আগ্রহীরা চাইলে দেখে নিতে পারেন।
১. http://fatwa.islamweb.net/fatwa/index.php?page=showfatwa&Option=FatwaId&Id=198413
২. http://fatwa.islamweb.net/fatwa/index.php?page=showfatwa&Option=FatwaId&Id=53577
৩. http://fatwa.islamweb.net/fatwa/index.php?page=showfatwa&Option=FatwaId&Id=33972
.
যাহোক, সব মিলিয়ে আশা করছি আপনাদের কাছে বিষয়টা এখন পরিষ্কার।
নারী দিবস শেষে আপাতত আপাতত এটাই ছিল আমার নারী দিবসের স্ট্যাটাস... :) :)
আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ!
.
---
লেখাটি ফেসবুকে- https://facebook.com/thealmahmud/posts/1247195052036689
Share:

1 comment:

  1. লেখাটা কেমন জানি হউএ গেল!!!

    ReplyDelete