[ক]
সেদিন সাবের চৌধুরী ভাই বলছিলেন,
"প্রত্যেকটা বই কালোত্তীর্ণ হতে হবে, এটা জরুরি না। একটা বই কিছুদিন - কিছু মানুষের প্রয়োজন পূরণ করেছে, এটাও খারাপ না।"
বিষয়টার সাথে আমি একমত, তবে আমি আরও কিছু কথা যোগ করতে চাই।
[খ]
ওপরের বিষয়টার বড় উদাহরণ হচ্ছে, শরিয়াত। পূর্বে আল্লাহ তা'আলা বিভিন্ন নবীকে শরিয়ত দিয়েছেন, সেগুলো একটা নির্দিষ্ট সময় পরে মানসুখ হয়ে গেছে। এরপর নতুন শরিয়াহ এসেছে। সবার শেষের শরিয়তে মুহাম্মাদী ﷺ, এটার উসুল-ফুরু' এতটা মজবুত আর বিস্তৃত যে, এরপর আর কিছুর দরকার নাই। কিয়ামত অব্দি এটাই যথেষ্ট।
কিন্তু পূর্বের নবীদের উম্মতের জন্য যখন যে বিধান দেয়া হয়েছে, সেটা কিন্তু ওই সময়ের জন্য অবশ্যই জরুরি এবং প্রয়োজনীয় ছিল। এটা মাথায় রাখতে হবে।
[গ]
আরেকটা বিষয় হল, আমাদের প্রত্যেকটা বই ইউনিক হতে হবে, এটাও জরুরি না। আব্দুল হক নামে এক লোককে দেখা যায়, আমাদের আলেমদের গালিগালাজ করে, আর মুতাযিলাদের প্রশংসা করে।
আমাদের আলেমদের ক্ষেত্রে তার করা আপত্তির একটা হচ্ছে, 'উনারা চর্বিত চর্বন করে, নতুন কিছু সৃষ্টি করে না।' এখানে বিষয় হল ভাই, ইসলামী ইলমের মাঝে নতুন কিছু আবিষ্কার কেন করবে? এই অধিকার কি কারও আছে? আমাদের শাস্ত্রগুলোর দিকে খেয়াল করেন,
উলুমুল হাদিস – সেই নবীজির কথাগুলোই, বারবার, বিভিন্ন বর্ণনায় আসছে। তাকরার বাদে ইউনিক মতন আর কয়টাই বা আছে। রিজাল শাস্ত্রেও সেই হাদিসের রাবিদের নিয়েই কথাবার্তা। কিন্তু এগুলো আলোচনা কেন বাদ দিব আমরা? এগুলো পুরানাবৃত্তি ও চর্চা রাখাই তো দরকারি।
উলুমুল কোরআন এবং তাফসির – এইখানেও ঘুরেফিরে সেই তাবারি আর রাযীর কথাগুলোই সবাই বলে। যুগে যুগে বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে হয়তো সামান্য মন্তব্য যোগ হয়। কিন্তু মূল কথা ঘুরেফিরে প্রায় একই থাকে। আর আল্লাহর কালামের ব্যাপারে মুসলিমদের বুঝ এক হইলেই তো বেশি ভাল, তাইনা? আর আমি কেন কামনা করবো যে, একটি ঘর – একটি আকিদা প্রকল্প গড়ে উঠুক। অদ্ভুত!
এছাড়া আধুনিক তাফসির বা বিজ্ঞানের আলোকে ব্যাখ্যার নামে যা হয়, তার প্রায় শতভাগই আবর্জনা আর গাঁজাখুরি। এছাড়া এখন মিশনারিদের তত্বাবধানেও কোরানিস্ট মতবাদ বাজারজাত হচ্ছে। যাহোক, কথায় ফিরি।
ফিকহ – এখানে নতুনত্বটা কেমন? যার যা মনে হয় লিখে দেয়? না ভাই! আপনি যত আধুনিক বা নতুন মাসয়ালাই নিয়ে আসেন না কেন, সেই হাজার বছর পুরনো উসুল দিয়েই ইস্তিম্বাত হবে, দলিল-আদিল্লা থাকবে সেই কোরআন আর হাদিসই।
হ্যাঁ। এটা হতে পারে যে, অমুক মাসয়ালা নিয়ে আলোচনা করা হয়না, সহজে লেখা হয়না, একাধিক মাজহাবের তাতবিক ভালো মত দেয়া হয়, কেউ একজন করলো। কিন্তু ঘুরে ফিরে সেই একই শরিয়ত। সেই দেড় হাজার বছরের পুরনো ইসলামের আইনই।
তাজদীদ মানে দ্বীনের মাঝে নতুন কিছু সৃষ্টি করা না। বরং সময়ের ব্যবধানে আল্লাহর দ্বীনের ওপর চেপে বসা জঞ্জাল সাফ করে, আগাছা দূর করে নতুনের মত ঝকঝকে অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া। আদি ও আসল দিন ইসলামের চেহারা নতুন করে মানুষকে চিনিয়ে দেয়া।
[ঘ]
ইদানীং ইসলামি বই অনেক বের হচ্ছে তো, বইয়ের ব্যাপারে মন্তব্যকারির পরিমানও অনেক বেড়েছে। এর মাঝে দেখা যায়, অনেকের ইসলামি জ্ঞানের ধারা সম্পর্কে কোনো ধারণা নাই, কিন্তু হুট করে বলে দিচ্ছে – অমুক কাজটা উচিত হয়নাই, অমুক কাজ খারাপ করেছে, এটা কেন করল – সেটা কেন করলো।
ধরেন, বড় একটা বই। হাজার পৃষ্ঠার। কয়জন পড়বে এটা? কেউ যদি এটার সারসংক্ষেপ করে ২০০পেজের মধ্যে কিছু বের করে। অনেকেই গালিগালাজ করবে। অথচ তালখিস করা, মুখতাসার নুসখা তৈরি করা, এসব সালাফদের যুগে হরহামেশাই হত। হিদায়ার লেখক বড় কিতাব (মেবি ৯০খন্ড) লেখার পরে যখন বুঝেছেন এতবড় বই কেউ পড়বে না, তখন উনিই শর্ট করে হিদায়া বানাইছেন।
এছাড়া একাধিক বইয়ের সারাংশ করে লেখার রেওয়াজও ছিল। কিংবা কখনও বইয়ের লাইনের মাঝেমাঝেও শরাহ করা হয়েছে। যেমন আমাদের দরসে পড়া একাধিক বই (শরহে বেকায়া, শরহে জামি, হেদায়া, মেশকাত) আগের বইয়ের ওপর বেজ করে লেখা। ইবনে কাসীরের তাফসির এবং তারিখ দুইটাই আগের কিতাবের ওপর ভিত্তি করে লেখা। এরকম উদাহরণ শত না বরং হাজার হাজার। অনেক ক্ষেত্রে দুইটা বই-ই টিকে গেছে, আবার অনেক ক্ষেত্রে পরের বইটাই মানুষের জন্য বেশি উপকারী, বেশি যুগোপযোগী বা অধিক সমাদৃত হয়েছে।
এখন তাকি সাহেব থানবী রহ. এর কিতাবের ওপর আলোচনা করছে, রিনোভেট করছে, শরাহ করছে, এজন্য আপনি তাকে গালি দিবেন কেন? গালি দেয়ার শখ থাকলে, একদম ওপর থেকেই শুরু করেন না। নাহু, ফেকাহ, হাদিস, তাফসির কোন শাস্ত্রের ইমামরা বাদ যাবে আপনার তীর থেকে?
[ঙ]
তবে ভাই, ‘নকল করা’ কিন্তু অন্য জিনিস, একই বাজারে (অর্থাৎ অঞ্চল ও সময় কমন) কোনো পণ্য ভাল চলছে, ডুপ্লিকেট বের করে সেটার নাম – ফেম হাতিয়ে নিতে চেষ্টা করা। হয়তো মানহীন জিনিস অন্যের মোড়ক কপি করে বাজারজাত করা। কিংবা অন্যের লেখা/অনুবাদ কপি করে নিজের নামে চালিয়ে দেয়া। এটার সাথে অন্য কারও কাজের ওপরে আবার ইলমি কাজ করার বিস্তর ফারাক রয়েছে। এক্ষেত্রে উদ্দেশ্য ও বিধেয় দুইটাই ভিন্ন। সুস্থ মস্তিষ্কের সব মানুষেরই বিষয়টা বোঝার কথা।
শুরুর কথা আবার দোহরাই, এটা জরুরি না প্রতিটা বই কেয়ামত অব্দি টিকে থাকতে হবে, কিংবা এটাও জরুরি না প্রত্যেককে হরহামেশা নতুন কিছু আবিষ্কার করতে হবে। একটা লেখা কিছুদিন মানুষের প্রয়োজন মিটিয়ে হারিয়ে যেতে পারে, পুরনো কিংবা ভিনদেশি কাজের ওপরেও নতুন করে কাজ হতে পারে। প্রত্যেকে তার আমল এবং নিয়ত অনুযায়ী প্রতিদান পাবে।
কোরআনে এসেছে ‘ফেনা তো উধাও হয়ে যায়। আর যা মানুষের জন্য উপকারী তা ভূমিতে থেকে যায়। আল্লাহ এভাবেই উপমা দিয়ে থাকেন।‘ (সুরা রা’দ:১৭)
----
0 comments:
Post a Comment