caution: এই লেখা সবার জন্য না, হজম করতে পারলে খাবেন, নইলে দূরে থাকবেন। আলেম এবং তালেবে ইলমদের মতামত সাদরে গ্রহণযোগ্য। তথ্যগত ভুল পেলে অবশ্যই ধরিয়ে দিবেন।
----
[ক]
সে বছর আমি বনানী মাদরাসায় হিদায়াহ পড়ছি। আমাদের ক্লাস যে উস্তাযের ইহাতায় ছিল, উনার বাড়ি কক্সবাজার। একবার মাসিক ছুটিতে হুজুর বাড়ী গেলেন, শনিবার ফিরবেন। তো আমাদের উস্তায না থাকলে অন্য হুজুরের আমাদের দেখাশোনার দায়িত্বে থাকে, তখন দিনকাল একটু মুশকিলেই যায়!
তো যাই হোক, শনিবারের দিন আমি গোসল করে এসে রুমে ঢুকেছি, দেখি হুজুর চলে এসেছেন! ক্লাসের সব ছাত্ররা হুজুরকে ঘিরে বসে আছে, ভালোমন্দের খোজ খবর নিচ্ছে। আর একটা বোতলে পানি কয়েকজন ভাগাভাগি করে খাচ্ছে!
জিজ্ঞেস করলাম কিসের পানি ভাই?
একজন বোতলটা এগিয়ে দিল- খাআ! জমজমের পানি!
আমি বোতল হাতে হুজুরের দিকে তাকাইলাম, প্রশ্নবোধক চাহুনি। হুজুর বললেন – খাও!
আমি তো ফিদা! মনের সকল ভক্তি শ্রদ্ধা মিশ্রিত করে, পশ্চিম দিকে ফিরে দোয়া করলাম “আল্লাহ আমাকে ইমাম সুয়ুতি রহ. এর মত ইলম দাও” (জমজমের পানি খাওয়ার সময় নিয়াত করলে কবুল হয়) এরপর বিসমিল্লাহ বলে ঢকঢক করে বোতলের পানি খেয়ে নিলাম।
কে যেন ফিক্ করে হেসে দিল! আর হুজুর হেসে বললেন – “এটা আমাদের বাড়ির টিউবওয়েলের পানি!!!”
পরে খেয়াল হল, ওহহো! হুজুর তো খেতে বলেছিল, এটা জমজমের পানি এই কথা তো হুজুর বলেনি!! আহারে…
[খ]
আমার দোয়া শুনে তখন হুজুর একটা কথা বলেছিলেন, “সুয়ুতি না! দোয়া করবে আল্লাহ যেন ইমাম রাযীর মত তাওফিক দেয়।”
হিদায়ার বছর আমি ইমাম সুয়ুতি রহ.এর সিরাম লেভেলের ফ্যান ছিলাম। আমরা আগাগোড়া হানাফি হলেও সেবছর আমাদের সিলেয়াসের প্রায় অর্ধেক কিতাবই ছিল শাফেয়ীদের লিখা। তখন আমরা হাদিস তাফসির দুইটাই শাফেয়ী আলেমদের কিতাব থেকে পড়েছি। ফিকাহ এবং সাহিত্য ছিল হানাফি আলেমের সংকলন। হাম্বলী কার যেন কিতাবও ছিল। (মাজহাবের ইখতেলাফ উম্মতকে টুকরা-টুকরা করে ফেলেছে তাইনা? কিন্তু আমরা তো সবাইকে একসাথেই পাইলাম!!)
তো, সেবছর তাফসীরে জালালাইন পড়েছিলাম, সেই সূত্রে জালালাইনের দুজন লেখকের জীবনী মুতালাআ করা হয়। ইমাম সুয়ুতির জীবনী আমাকে খুবই মুগ্ধ করেছিল। আল্লাহু আকবার! উনি কত জ্ঞানী ছিলেন, অনেক খিদমাত করেছেন। হাদিস, ফিকাহ, তাফসির তিনশাস্ত্রেই মাহের ছিলেন!
উনার দুটি তাফসির গ্রন্থ প্রসিদ্ধ, জালালাইনের প্রথম পনের পারা, যা মাত্র ৪০দিনে লিখেছেন। আর ‘দুররে মানসুর; তাফসির বিল মাসুর’ এটা তাফসিরে মাযহারি অথবা ইবনে কাসিরের মত রিওয়ায়েত প্রধান তাফসির, যেখানে হাদিস এবং সালাফের বর্ণনা বেশি বেশি উদ্ধৃত হয়েছে। ফিকহের ক্ষেত্রে উনি ইমাম শাফেয়ী রহ.এর ইত্তিবা’ করতেন। উসুলে ফিকহের কিতাবও উনি লিখেছেন। আর হাদিসের কথা বলবেন? ২ লক্ষ হাদিসের হাফিজ ছিলেন!!
সব মিলিয়ে উনার লাইফস্টোরি পড়তাম আর আমি “হা--” হয়ে থাকতাম। কেম্নে পারে ম্যান!!
[গ]
তবে একটা কথা কি? ইমাম সুয়ুতি রহ. এবং ইবনে তাইমিয়া রহ. জীবনী নিয়ে ফিকির করলে বুঝা যায়, একজন মানুষ সব বিষয়ে দখল নিতে গেলে ইলম এবং ফিকরের মাঝে কিছু কিছু বড় তাসামুহ হয়ে যায়, এবং এর প্রভাব উম্মাতের ওপর পড়লে ফলাফল তেমন স্বস্তিকর হয় না। ইবনে তাইমিয়া রহ. এর ব্যাপারটা আরও স্পর্শকাতর ছিল, কারণ উনি সব বিষয়ে তেমন উস্তায পাননি। আর কম বয়সেই উনি ফাতওয়া ইত্যাদি প্রদান শুরু করে দিয়েছিলেন। কোন একজন আলেম ইবনে তাইমিয়া রহ. এর ব্যাপারে বলতে গিয়ে এভাবে বলছিলেন – “উনি ইলমে হাদিসে অসাধারণ কাজ করেছে, এরপর ফিকহে গিয়েও ভালোই ছিল; কিভাবে যেন কিছু কিছু শুযুযাত প্রকাশ হয়ে গেল। আসলে ফিকহের ক্ষেত্রে শুধু স্মরণশক্তি ভালো হলেই হয় না, আরও কিছু লাগে। এরপর ইবনে তাইমিয়া রহ. যখন ইলমে কালামে হাত দিলেন এবার তো পুরাই শেষ করে দিয়েছেন! উনি ইলমে হাদিসে খিলাড়ি হলেও ইলমে কালামে আনাড়ি!”
সত্যি বলতে “সব শাস্ত্রে পারফেক্ট” “একজন মানুষ সবদিকেই মেহনত করবে” এটা নবী-রাসুল ছাড়া আর কারও সাথে যায় না। একদমই না, আমার কোন উস্তায বলেছিলেন – যেকোন একটা ধরে উঠে যাও, সবদিকে খেতে গেলে দিন শেষে ভুখাই থেকে যাবে। তখন কেউ হয়তো বলবে “সব ফনের চাপাবাজ, কোন ফনে মাহের না!”
আমার হাদিসের উস্তাযদের মধ্যে প্রিয় একজন উস্তায, যার কাছে মুসলিম শরিফ পড়েছি ‘নাম না বলি’। উনার দরস অসাধারণ ছিল, ইমাম রাযির মত উনি মাঝেমাঝেই অনেক দীর্ঘ আলোচনা শুরু করতেন, পরে একদিন জানলাম উনি ইমাম তাজ উদ্দিন সুবকি এবং ইবনে তাইমিয়া রহ.এর ফ্যান!
আল্লাহ সবাইকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মর্যাদায় ভূষিত করুক। আমিন!
[গ]
ইমাম রাযি রহ. – ইসলামের ইতিহাসের দুজন “রাযি” আছে। একজন হচ্ছে মুহাম্মাদ বিন জাকারিয়া রাযী। (২৫০-৩১১ হি.) উনি একজন মুসলিম বিজ্ঞানী, রসায়নবিদ। দর্শনেও কিছু কাজ করেছেন উনি। তবে উনার অবদান চিকিৎসা বিজ্ঞানে অনেক বেশি। রুকইয়াহ শারইয়্যাহ নিয়ে কেউ বিস্তারিত পড়াশোনা করতে চাইলে তাকে এই রাযী রহ. এর “আখলাকুত ত্ববীব” (চিকিৎসকের শিষ্টাচার) পড়তে পরামর্শ দেয়া হয়।
আরেকজন হচ্ছেন শাইখুল ইসলাম আবু আব্দিল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনুল উমার রাযী। known as ইমাম ফখরুদ্দিন রাযী। (৫৪৪-৬০৬ হি.) কেউ শুধু ইমাম রাযী বললে, ইমাম ফখরুদ্দিন রাযি রহিমাহুল্লাহকেই বুঝানো হয়। আমরা তাকে নিয়েই সামান্য আলোচনা করব।
ইমাম রাযি রহ. এর অমর কৃতী হচ্ছে তাফসিরে কাবির। আসলেই সবচেয়ে বড় আর সবচেয়ে তথ্যবহুল তাফসির। এটার আসল নাম “মাফাতিহুল গাইব।” ইমাম রাযি রহ. এই তাফসিরের কাজ শেষ করতে পারেননি, উনি ২৬পারার সুরা ফাতহ পর্যন্ত লিখেছেন। এরপর আল্লাহ উনাকে দুনিয়া থেকে উঠিয়ে নিয়েছে। বাকি সাড়ে চার পারা অন্য দুজন বিজ্ঞ আলেম লিখেছেন ইমাম রাযীর লেখার ধাঁচ ঠিক রেখেই। তাকি উসমানী হাফিযাল্লাহু উনার উলুমে কোরআন গ্রন্থে তাফসিরে কাবিরের অনেক প্রশংসা করেছেন। উইকিপিডিয়াতে তার চম্বুকাংশ উল্লেখ হয়েছে। (কমেন্টে লিংক দিব ইনশাআল্লাহ)
তাফসিরে কাবিরের সমস্যা আছে একটা, অনেক অনেক দীর্ঘ বিশ্লেষণ। এক আয়াতের সাথে যতরকম শাস্ত্রের কানেকশন থাকতে পারে, তাফসির বিল রাই তাফসির বিল মাসুর যা আছে ইমাম রাযি রহ. প্রায় সবকিছুই জড় করতে চেষ্টা করেছেন! সুবহানাল্লাহ! সুরা ফাতিহা নিয়ে আলোচনা প্রায় দেড়শ পৃষ্ঠা।
আমি রুকইয়াহ নিয়ে মুতালায়া করতে গিয়ে যত তাফসির পেয়েছি সবগুলোর সুরা বাকারার ১০২ আয়াতের তাফসির পড়ার চেষ্টা করেছি। তো এই তাফসিরে কাবির আর তাফসিরে তাবারি পড়তে গিয়ে কয়েক পৃষ্ঠা পর হাঁপায় গেছি, আর পড়িনি!
মজার আরেকটা তথ্য, যাদুবিদ্যার নাঁড়িনক্ষত্র সম্পর্কে ইমাম রাযি রহ. অনেক ভালো জানতেন। ইমাম রাযি রহ. এবিষয়ে অনেক খোলাখুলি আলোচনা করার কারণে ইবনে তাইমিয়া রহ. এবং উনার ছাত্ররা বেশ আপত্তি দেখিয়েছে! আমার একজন আকাইদের উস্তাযের মুখে শুনেছি, ইবনে তাইমিয়া রহ. নাকি ইমাম রাযীকে এই কারণে তাকফিরও করেছেন!! আল্লাহ মাফ করুক। তবে একটা জিনিস কি জানেন? আপনি যদি বাকারা ১০২ আয়াতের তাফসির পড়তে গিয়ে ইমাম রাযির তাফসির প্রথমে পড়েন, এরপর আপনি যেই তাফসিরই পড়বেন, ইমাম রাযির কথাগুলো থেকেই সবাই পুনরাবৃত্তি করেছে, ইমাম রাযি সব একসাথে বলেছেন, বাকিরা সেখান থেকে অল্প অল্প করে নিয়েছে।
Wiki says, the personal experience of Mufti Muhammad Taqi Usmani is that whenever [he has] found a difficulty, it (Tafsir al-kabir) has guided [him] to the right answer.
ইমাম রাযি রহ.এর কর্মক্ষেত্র মূলতঃ দর্শন, আক্বাইদ, আধ্যাত্মিকতা, তাফসির এসব নিয়ে। আর উনিও শাফেয়ী।
হ্যাঁ! আমি ইমাম সুয়ুতির পাশাপাশি ইমাম রাযিরও ফ্যান..
আল্লাহ যেন আমাকেও উনাদের মত তাওফিক দেয়, আমিন!
আসসালামু আলাইকুম উস্তাদ।
ReplyDeleteআপনি পোস্টে কক্সবাজারে আপনার একজন উস্তাদের কথা বললেন।উনার নামটা কি একটু বলবেন?
আমার বাসা কক্সবাজার।
জেনারেল লাইনে পড়াশোনা করেছি।অনেক বিষয় নিয়ে আটকে যাই অনেক সময়।নাম বললে উস্তাদের সোহবতে যাওয়ার চান্স পেতাম।এই আরকি🙂
উনি তো সাধারণত ঢাকাতেই থাকেন। মাসে/দুইমাসে হয়তো একবার বাড়ি যান আরকি। সবসময় পাওয়া যায় এমন স্থানীয় আলেমদের সাথে থাকা বেটার।
Delete